লাদাখ: এক পাহাড়ি প্রতিবাদ
“লাদাখ” ভারতের এক অন্যতম ইউনিয়ন territory আজ অশান্ত, বিক্ষিপ্ত, ছন্নছাড়া হয়ে উঠেছে। সেখানে বাসিন্দারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে, গর্জে উঠছে, দাবি রাখছে ভারতীয় সরকারের কাছে। কিন্তু ঠিক আসল কারণ কি? কি কি দাবি রয়েছে তাদের(Ladakh people)?
আসুন, লাদাখ জায়গাটির ভৌগোলিক তথ্য সম্পর্কে একটু জানা যাক। “লাদাখ” বা “লা-দ্বাগস” (তিব্বতি ভাষায়) উত্তর ভারতের একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল যার উত্তরে রয়েছে কুনলুন পর্বত শ্রেণী, দক্ষিণে হিমালয় পর্বতমালা, পূর্বে তিব্বত ও পশ্চিমে পাকিস্তানের গিলগিত-বালতিসতান অঞ্চল। দেশের জাতীয় নিরাপত্তার কথা ধরতে গেলে লাদাখ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে লাদাখের দূরত্ব 2486 কিলোমিটার হলেও আমাদের জানা দরকার সেখানে কি ঘটছে আর তার সুদূর প্রসারী ফলাফল কি হতে পারে।
৩১ শে অক্টোবর, ২০১৯, এর আগে এই অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতীয় আইনের article 370 রদ হবার পর এটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। লাদাখ এর মানুষ(Ladakh people) সেই সময় খুশি হয়ে এই প্রস্তাবনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
কিন্তু আজকে বাস্তব চিত্রটা অনেকটাই আলাদা, এখানকার বিখ্যাত সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ও পেশায় ইঞ্জিনিয়ার “সোনম ওয়াংচুক” (২০০৯ সালের হিন্দি ছবি ‘3idiot’s’ এর বিখ্যাত চরিত্র ‘রানর্ছোড়দাস চাঁচড়’ চরিত্রটি যার ছায়া অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল। ) কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ২১ দিনের জন্য অনশনে বসেছিলেন আর তার পাশে ছিলেন লাদাখের তামাম জনতা।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এত বড় একটি আন্দোলন সম্পর্কে ভারতীয় ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিনট মিডিয়া কোনও নিউজ কভারেজ করছে না। কেন? মেরুদণ্ডের বড় অভাব যে, সেটা আমি , আপনি সবাই জানি। কারণটা এখানে আলাদা করে উল্লেখ করবার প্রয়োজন নেই।
মূল বিষয়ে ফিরছি। প্রথম থেকেই লাদাখের মানুষের দুটো দাবি ছিল।
১) জম্মু ও কাশ্মীরের থেকে তাদের আলাদা করে স্বাধীন কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হোক।
২) তাদের 6th Schedule এর আওতায় আনা হোক।
২০১৯ সালে যখন Article 370 রদ করা হয় তখন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের থেকে আলাদা করে লাদাখ কে স্বাধীন কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল রুপে মান্যতা দেওয়া হয় অর্থাৎ একটি দাবি মানা হয়, কিন্তু ruling party তার নিজস্ব manifesto তে গ্যারান্টি দিয়েছিল যে লাদাখ কে 6th Schedule এর আওতায় আনা হবে, কিন্তু আজ অবধি তার কাজ হাতে কলমে কিছুই হয় নি।
কিন্ত জম্মু ও কাশ্মীরের থেকে লাদাখ আলাদা হতে চেয়েছিল কেন? এটা জানতে গেলে লাদাখের demography জানতে হবে। জম্মু ও কাশ্মীরে মুসলিম (৬৮.৮%); সেখানে লাদাখে মুসলিম (৪৬.৪১%), বৌদ্ধ (৩৯.৬৫%), হিন্দু(১২.১১%),শিখ(০.৮৩%),খ্রিষ্টান(০.৪৬%)জৈন (০.০৫%)আর বাকি ধর্মাবলম্বী (২%) রয়েছে। মানে অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা সেখানে। তাই এক্ষেত্রে পাশাপাশি অঞ্চল হওয়া স্বত্বেও সংস্কৃতি গত দিক থেকে অনেক পার্থক্য ছিল। তাই লাদাখের মানুষের বরাবর অভিযোগ ছিল যে তারা জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারের থেকে সব সরকারি সুযোগ সুবিধা ঠিক মতো পায় না। তাই তাদের দাবি ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের থেকে তাদের বিভক্ত করে দেওয়া হোক।
এবার জানতে হবে 6th Schedule ব্যাপারটা কি? উত্তর পূর্ব ভারতের চারটি রাজ্য আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরা – এখানে বহু বছর ধরে বিভিন্ন তফশিলি ও উপজাতি সম্প্রদায়রা বাস করেন, বলা বাহুল্য এদের দৈনন্দিন জীবন যাপন পদ্ধতি, বাসস্থান, প্রয়োজনীয়তা আমাদের থেকে অনেকটাই আলাদা। তাই ভারতীয় সংবিধানে “Sixth Schedule ” এর “Article 244 (2) ও 275 (1) তে এই তফশিলি জাতি ও পাহাড়ি উপজাতি দের বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে তাদের নিজস্ব রাজ্যে অঞ্চল, জায়গা সম্পর্কে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার। এই বিষয়ে দেশের রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত তাদের শিক্ষাগত ও সংস্কৃতিগত বিষয়ে কোনও প্রভাব ফেলতে পারে না,। লাদাখে যেহেতু টিবেটিয়ান বৌদ্ধ ও বিভিন্ন পাহাড়ি উপজাতি রয়েছেন, তাই তারা দাবি করেছেন লাদাখ কে “Sixth Schedule” এর আওতায় আনা হোক, এবং এটা তো সরকারি ruling party এর manifesto তে গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল।
“Sixth Schedule ” ছাড়াও আরও কিছু চাহিদা বা দাবি এখানকার মানুষের রয়েছে। যেমন:
১) Statehood বা Legislature: আগে লাদাখের administrative work জম্মু ও কাশ্মীরের capital থেকে করা হতো, এখন সরাসরি দিল্লি থেকে করা হয়। লাদাখের মানুষ চায় সেটা লাদাখের আঞ্চলিক শিক্ষিত নবীন প্রজন্ম কে দিয়ে করানো হোক।
২) MLA নির্বাচিত হোক লাদাখ অঞ্চল থেকে এবং সরকার বানাতে দেওয়া হোক।
৩) এই মূহূর্তে এই অঞ্চলে MP এর সংখ্যা মাত্র ১জন, আরও MP নির্বাচিত হোক যাতে পার্লামেন্টে তাদের দাবি ও প্রয়োজনীয়তা জানাবার প্রতিনিধি থাকে।
৪) রাজ্যের উন্নয়নের জন্য Public Service Commission গঠন করা। এতে সরকারি চাকরির পদ তৈরী হবে ও আঞ্চলিক বেকার শিক্ষিত নবীন প্রজন্মর কাজের সংস্থান হবে।
উক্ত দাবি গুলো ছাড়াও লাদাখের মানুষ ও activist সোনম ওয়াংচুক এর পরিবেশ সংক্রান্ত কিছু দাবি রয়েছে।
২০১৯ সালের পর থেকে এই ছবির মত সুন্দর পার্বত্য উপত্যকায় বিভিন্ন constructions projects চালু হয়েছে।মাইনিং, রোড construction, Hydraulic power এরকম বিভিন্ন projects নিয়ে private industrialists রা এখানে কাজ শুরু করছেন। এখানকার বাসিন্দারা মনে করছেন যে নির্দিষ্ট কিছু সংস্থা যারা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের “Electoral Bond” কিনেছে, তাদের কাছে লাদাখ কে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর আগে এমন ঘটনা ঘটে নি ,কারণ ২০১৯ এর আগে ঠিক জম্মু ও কাশ্মীরের মতোই লাদাখের জমি বেচা কেনা ও জমির উপর কোনও রকম constructions, mining, projects সব কিছু করতে গেলেই সেখানকার PRC (Permanent Residential Certificate) এর প্রয়োজন হতো, এর নেপথ্যে ছিল Article 370, যেটির এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই।
কিন্তু Industry তৈরী হলে, শিল্প গঠন হলে, উন্নয়ন বাড়লে সেখানে পর্যটন উন্নত হবে, তাতে আসলে তো লাদাখের মানুষের লাভই হবে, তাহলে তাদের আপত্তি কোথায়?
এর উত্তর জানতে গেলে অতীতের উদাহরণ হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এর বন্যা, landslide এর ঘটনা মনে করতে হবে।ওখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই manmade ছিল, অসংখ্য মানুষ মারা গেছিলেন আর সম্পত্তির কত ক্ষতি হয়েছিল তার হাতে কলমে কোনও হিসেব নেই। কারণ ছিল লাগাম ছাড়া ভাবে hydropower projects তৈরী, বড় বড় রোড construction এর কাজ এর অনুমোদন দেওয়া।
লাদাখে ও এই একই কাজ শুরু হয়েছে। এখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন লাদাখ বাসী। এখানকার সঞ্চিত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে বড় project বানাতে চাইছে private industrialists রা। এখানে পৃথিবীর প্রথম glaciated road তৈরী করবার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এশিয়ার দীর্ঘতম জোজিলা টানেল যা ২০৩০ এর মধ্যে সম্পূর্ণ করবার প্রস্তাবনা নেওয়া হয়েছে।
লাদাখের বাসিন্দাদের বিপরীতে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু বক্তব্য রয়েছে। লাদাখ চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বর্ডার শেয়ার করে। তাই জাতীয় নিরাপত্তার দিক দিয়ে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০ সালে লাদাখের গালেয়ান অঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২০ জন জওয়ান শহীদ হয়েছিলেন। এরপর ও এরকম ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তা রেখার ওপারে চীন তাদের military presence ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। ফলে ভারতীয় সেনা বাহিনী কেও একই রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে। সরকারের বক্তব্য এই Hydraulic project, road construction, mining সবকিছু দরকার আছে জাতীয় নিরাপত্তা মজবুত করার জন্য, ভারতীয় সেনা বাহিনীকে সহায়তা প্রদানের জন্য। সরকারের ধারণা লাদাখ যদি “Sixth Schedule ” এর আওতায় আসে তাহলে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা আসতে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, লাদাখের মানুষ প্রথম থেকেই ভারত সরকার ও ভারতীয় সেনা বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করেছেন। সোনম ওয়াংচুক নিজেও ভারতীয় সেনা বাহিনীর জন্য অনেক সহযোগিতা মূলক কাজ করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে সেখানে বাসিন্দারা বাধা বা বিদ্রোহ করতে পারেন এমন ধারণা ঠিক নয়। ভারতীয় অন্যান্য রাজ্যের মতো লাদাখের বাসিন্দাদের ও তাদের প্রাপ্য অধিকার দেওয়া উচিত। তাহলে তারা আবার সরকারের উপর আস্থা ফিরে পাবেন। এখানকার স্বর্গের মতো প্রকৃতি কে বাঁচিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার ভিত মজবুত করতে যা যা করা দরকার তা ভারত সরকার, ভারতীয় সেনা বাহিনী ও লাদাখের মানুষ দের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগঠিত ভাবে করতে হবে।
Find more News Articles